Monday, February 12, 2018
ফাঁস ঠেকাতে প্রশ্নের প্যাকেটে থাকবে নিরাপত্তা যন্ত্র
কেন্দ্রেই ছাপানো হবে ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন * আসন্ন প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষায় এ পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু * কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে মোবাইল ফোন পেলেই গ্রেফতার
মুসতাক আহমদ ও নুরুল আমিন
পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিশেষ নিরাপত্তা ডিভাইসযুক্ত (যন্ত্র) খামে পাঠানো হবে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে দেশের কোথাও প্রশ্নের প্যাকেট খুললে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বার্তা পাঠাবে সেই ডিভাইস। সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশ্নব্যাংক তৈরি ও নিরাপত্তা উপকমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের সমন্বয়ে এ বৈঠক হয়। ২ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, চলতি এসএসসি পরীক্ষায় ধারাবাহিক প্রশ্নফাঁসের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে প্রশ্নপত্রের প্যাকেটে এ প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন নয়। দু’বছর ধরে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্যাকেটে এই যন্ত্র ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এটা ‘তাৎক্ষণিক’ ব্যবস্থা। দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে সরকার স্থানীয়ভাবে বা পরীক্ষা কেন্দ্রে (অনলাইনে প্রশ্নব্যাংক পাঠানো) প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নিতে চায়। এ লক্ষ্যে একই কমিটি কাজ করছে। সোমবার বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপানোর চ্যালেঞ্জ ও ভুলত্র“টি নির্ণয়ে দশম শ্রেণির আসন্ন প্রি-টেস্ট এবং টেস্ট পরীক্ষায় এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র শতভাগ নিষ্কলুষ রাখতে চাই। প্রশ্ন যাতে কোনো দুষ্কৃতকারী পরীক্ষার আগে দেখতে না পারে, সে লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা ব্যবস্থার কথা বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।’
এদিকে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে উল্লিখিত দুই ধরনের পদক্ষেপের চিন্তা করলেও ছাপা পর্যায়েই প্রশ্নফাঁসের শঙ্কার কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। তারা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এবারের এসএসসির ইংরেজি প্রথমপত্র ও আইসিটির দুই সেট প্রশ্ন অনেক আগেই ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র প্রশ্ন পরীক্ষার প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে এবং গণিতের প্রশ্ন আগের রাতে ফাঁসের অভিযোগ আছে। এতে প্রতীয়মান হয়- পরীক্ষার দিন সকালে নয়, আগেই ফাঁস হয়ে গিয়ে থাকতে পারে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয় মাথায় নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন এবং বিজি প্রেসের দিকে নজরদারি জোরালো করার পরামর্শ দেন।
প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকায় এরই মধ্যে গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদেও এসব তথ্য পাওয়া গেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষার আগের রাত কিংবা ট্রেজারি থেকে পরীক্ষার কেন্দ্রে পাঠানোর পথে নয়, ছাপাখানায় যাওয়ার আগেই হাতে লেখা প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে বলে রিমান্ডে আসামিরা জানিয়েছে। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যদের ধরতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় কঠোর নজরদারি করছিলাম। গণিত পরীক্ষার আগে রাতে শিক্ষা বোর্ডের করা হাতে লেখা প্রশ্ন কয়েকটি ফেসবুক পেজে চলে আসে। পরদিন গণিত পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে হাতে লেখা ওই প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়। অবশ্য হাতে লেখা প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব যুগান্তরকে বলেন, এসব কারণেই প্রশ্নব্যাংক তৈরি এবং প্রশ্নব্যাংক থেকে প্রশ্ন পাঠিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনা হচ্ছে। কেননা তখন পরীক্ষার আগে প্রশ্ন তৈরি ও ছাপানোর চিন্তা থাকবে না। ফলে ফাঁসের শঙ্কাও বন্ধ হবে। চিন্তাটি কতটা সঠিক, তা যাচাইয়ে আগামী বছরের প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষা প্রশ্নব্যাংক থেকে অনলাইনে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। ৩ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভায় এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন যুগান্তরকে বলেছিলেন, ‘প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে আমরা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিতে চাচ্ছি অনলাইনে পাঠানো প্রশ্নপত্রে। এভাবে পাবলিক পরীক্ষা নিলে কেমন হবে, তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা দরকার। সেজন্যই টেস্ট ও প্রিটেস্ট পরীক্ষায় পাইলটিং করা হবে। এতে ভুলত্র“টি, সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয়তা জানা হবে।’ তিনি বলেন, অনলাইনে প্রশ্ন পাঠিয়ে পরীক্ষা নেয়ার এ উদ্যোগ সফলভাবে প্রয়োগ হলে ২০১৯ সালের এসএসসি হবে একই পদ্ধতিতে। তখন আমরা আর প্রশ্ন ছাপাব না। পরীক্ষার ৩০ মিনিট আগে তা পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ফাঁস ঠেকাতে অনলাইনে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে কেন্দ্রে ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে গত বছরের ১২ জুলাই একটি মূল ও তিনটি উপকমিটি গঠিত হয়। তিন উপকমিটি হচ্ছে- প্রশ্নব্যাংক তৈরি, প্রশ্ন প্রিন্টিং এবং লজিস্টিক সাপোর্ট সংক্রান্ত; প্রিন্টিং ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ও লজিস্টিক সাপোর্ট সংক্রান্ত।
প্রশ্নব্যাংক তৈরি ও নিরাপত্তা উপকমিটির দায়িত্বে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১)। এ কমিটিতে আরও আছেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদসহ ১১ কর্মকর্তা। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে বিষয়, অধ্যায় ও প্রশ্নের মানবণ্টন অনুসারে সব বিষয়ের সম্ভাব্য প্রশ্ন প্রণয়ন করা। এরপর সব প্রশ্নের ডাটাবেস তৈরির মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্নব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা; যাতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে একাধিক প্রশ্ন সেট তৈরি করা যায়। এই কমিটির বৈঠকই সোমবার বুয়েটে অনুষ্ঠিত হল।
প্রিন্টিং ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা উপকমিটির দায়িত্ব হল পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য সফটওয়্যার তৈরি এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রশ্ন গ্রহণ ও পাঠানোর ব্যবস্থা করা এবং প্রশ্নপত্রে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ করা। আর লজিস্টিক সাপোর্ট উপকমিটির পদ্ধতি বাস্তবায়নের কারিগরি দিক মূল্যায়ন, চাহিদা তৈরি করে সুপারিশ করবে। এই তিন কমিটির কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানকে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা অটোমেশন পদ্ধতিতে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নিতে চাই। প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, এজন্য আমাদের যে খরচ হবে, তা বর্তমানে বিজি প্রেসে ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়ার তুলনায় অনেক কম।
মোবাইল ফোন পেলেই গ্রেফতার : প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে চলতি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ব্যাপারে সোমবার নতুন দুটি নির্দেশনা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর একটি হচ্ছে, পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে এবং কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোনসহ কাউকে পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করা হবে। অপরটি হচ্ছে- পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। নইলে তাকে আর কোন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা স্থগিত : ব্যাপক সমালোচনার মুখে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখার নির্দেশনা থেকে সরে এসেছে সরকার। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে সোমবার পরীক্ষা শুরুর সময় ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। সোমবার সকালে সব ইন্টারনেট গেটওয়েকে পাঠানো বিটিআরসির নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেটের গতি কমানোর বিষয়ে আগের নির্দেশনা স্থগিত থাকবে। অবশ্য নতুন এই নির্দেশনা কার্যকরের আগেই সকাল ৮টা থেকে আধা ঘণ্টার মতো ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে গ্রাহকদের। রোববার বিটিআরসির এক নির্দেশনায় সব এসএসসি পরীক্ষার শুরুতে আড়াই ঘণ্টা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখতে বলা হয়।
নবাবগঞ্জে ৬ শিক্ষার্থী আটক : নবাবগঞ্জ থেকে আজহারুল হক জানান, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় এসএসসির গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাব্বি, রুহান, শামীম হাসান, শাকিব, তৌহিদুল ও আলামিন নামে ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ।
উপজেলার বাহ্রা ও আলালপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রোববার রাতে তাদের আটক করা হয়।
নবাবগঞ্জ থানার এসআই আরাফাত হোসেন জানান, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শনিবার সকাল ৯টার দিকে নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের মূল ফটকের সামনে থেকে বক্সনগর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক রনি মিয়া (২৮) ও বাহ্রা ওয়াছেক মেমোরিয়াল হাইস্কুলের শিক্ষক সোহেল রানাকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে ওই ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment