প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগর-বসতিগুলোর মধ্যে অন্যতম মহেঞ্জোদারো। বর্তমানে এটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার অন্তর্গত। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো। প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া এবং ক্রিটের সভ্যতার সমসাময়িক এই সভ্যতার অতি পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে আজো এক বিস্ময়।

এখানকার রাস্তাঘাট, পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থাই বলে দেয় দক্ষ নগর পরিকল্পনাবিদদের চিন্তার সমন্বয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আধুনিক যুগে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ কিংবা সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী করাচির মতো শহরে যেখানে পানি সমস্যা প্রকট সেখানে সাড়ে চার হাজার বছর আগেও মহেঞ্জোদারোতে উত্তম পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। অতো আগেও কীভাবে নির্বিঘ্নে পানি সরবরাহ, পয়:নিষ্কাশন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল তা সত্যিই মানুষকে ভাবায়।
সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল ইরান সীমান্ত, দক্ষিণে ভারতের গুজরাট, উত্তরে বাক্ট্রিয়া পর্যন্ত। সেই সময়ে পুরকৌশল ও নগর পরিকল্পনায় মহেঞ্জোদারো ছিল শ্রেষ্ঠ। ঐতিহাসিকদের মতে, সিন্ধু সভ্যতার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল মহেঞ্জোদারো। এই শহরের গণভবনগুলি উচ্চমানের সামাজিক সংগঠনের পরিচায়ক। সেই সময়েই সেখানকার মানুষ ফ্লাশযুক্ত টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। তাদের পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশনের এমন চমত্কার ব্যবস্থা ছিল, যা আধুনিক পাকিস্তানের অনেক শহরকেও হার মানায়। প্রায় ছয়শ বছর টিকে ছিল মহেঞ্জোদারো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০ সালে সিন্ধু সভ্যতার আকস্মিক পতন হলে পরিত্যাক্ত হয় মহেঞ্জোদারো।
মহেঞ্জোদারো শহরের মোট আয়তন ৫০০ একর যা কিনা ভ্যাটিক্যানের থেকে পাঁচগুন বেশি। বিভিন্ন সমেয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা দুই স্তর বিশিষ্ট এই শহর খননের পর তামা ও পাথরের সরঞ্জাস, দাঁড়িপাল্লা, ওজন করার বাটখারা, স্বর্ণ ও জ্যাসপার গয়না এবং নানা ধরনের শিল্পকর্ম খুঁজে পেয়েছেন। তবে মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কৃত সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ স্থাপনা হলো মহাস্নানাগার। এটির দৈর্ঘ ও প্রস্থ যথাক্রমে ১২ মিটার এবং ৭ মিটার (প্রায় ৯০০ বর্গফুট আয়তনের) এই স্নানাগারটি নির্মিত হয়েছিল পোড়া ইট দিয়ে। আর জল বেরিয়ে যাওয়া রোধ করতে ব্যবহার করা হয় বিটুমিনের সারি। সিন্ধু সভ্যতা এবং মহেঞ্জোদারোর ইতিহাসের একেবারে শেষভাগে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে স্নানাগারটি।
পরিত্যাক্ত হওয়ার পর একবিংশ শতক পর্যন্ত মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না। ১৯২১ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্বদিব রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম মহেঞ্জোদারো পুনরাবিষ্কার করেন। ১৯৩০-এর দশকে স্যার জন মার্শাল, কে. এন. দীক্ষিত, আর্নেস্ট ম্যাককি ও অন্যান্যদের অধীনে এখানে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়। ১৯৪৫ সালে আহমদ হাসান দানি ও মর্টিমার হুইলারও এখানে খনন কাজ পরিচালনা করেন। আর শেষ বড় খনন কাজটি চলে ১৯৬৪-৬৫ সালে ড. জি. এফ. ডেলসের অধীনে। এরপর উন্মুক্ত স্থাপনাগুলি আবহাওয়াজনিত ক্ষয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেখে এখানে খনন কাজ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। -ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক.
No comments:
Post a Comment